GM MEDIA

খুলনার জানা-অজানা ঐতিহাসিক বধ্যভূমি

হাবিবা খাতুন : ১৬ ডিসেম্বর লাখো শহীদের রক্তমূল্যে অর্জিত মহান বিজয় দিবস । ১৯৭১ সালে ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হয়।৭১’র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো খুলনায়ও। তখন হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করতো স্থানীয় আলবদর ও রাজাকার সদস্যরা। যেসব স্থানে এমন হত্যাযজ্ঞ চলতো সেসব আজও কালের স্বাক্ষী। যা মনে করিয়ে দেয় একাত্তরের বর্বরতা।
গল্লামারি বধ্যভূমিঃ খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় কিলোমিটার দূরে গল্লামারির অবস্থান। এখানে অসংখ্য বাঙ্গালিকে হত্যা করা হয়। ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলাদর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সকলের চোখের সামনে দিনের বেলায় পিঠ মোড়া দেয়া ট্রাক ভর্তি বাঙালীদের নিয়ে যাওয়া হত আর ঘণ্টাখানেক পর শূন্য ট্রাক ফিরে আসত। শোনা যায়, খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারিতে দুই ট্রাক মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল।

ফেরিঘাট বধ্যভূমিঃ ফেরিঘাট এলাকায় পাক সেনারা লঞ্চ-স্টিমারের যাত্রীদের ধরে এনে মালামাল লুটপাট করে হত্যা করত এবং লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিতো।

রেল স্টেশনের বধ্যভূমিঃ খুলনা নগরীর কেন্দ্রস্থলে রেলস্টেশন ও রেল লাইনের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে করা হয়েছে বাঙালী নিধন। একাত্তরের এপ্রিল-মে মাসে খুলনা রেল স্টেশন এলাকাতে বহু বাঙ্গালিকে হত্যা করা হয়। এদের অনেকেই জেলার বাইরে থেকে আসা রেলযাত্রী। সব কিছু লুটপাট করে মেরে লাশের পেট চিরে নদীতে ফেলে দিত তারা।
রেল কলোনি সংলগ্ন ডোবা বধ্যভূমিঃ পাকসেনা সহযোগী একদল অবাঙালীর প্রাধান্য ছিল রেল কলোনি এলাকায়। সে সময় কলোনি এলাকাতে দিনে বা রাতে যখনি বাঙালী গিয়েছে সে আর ফেরেনি। মেরে পুতে রাখা হয়েছে সেখানে। কলোনিতে বসবাসকারী অনেক বাঙালী রেল কর্মচারীও এই হত্যার শিকার হয়েছে। এখান থেকেই খুলনা থানার তৎকালীণ দারোগা আবুল কাশেমের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এলাকার আসিয়ানী হোটেলের সামনের বিরাট ডোবায় বহু বাঙালীর লাশ নিক্ষেপ করা হয়। এখান থেকে বস্তা বন্দী লাশও উদ্ধার করা হয় পরে।

কাস্টমঘাট বধ্যভূমিঃ খুলনা রূপসা নদীর পাড়ে কাস্টমঘাট ছিল একটি বধ্যভূমি। এই কসাইখানাটি পাকিস্তানীদের সদর দপ্তরের সামনে ছিল। এখানে বাঙালীদের হাত পা বাঁধা অবস্থায় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত জল্লাদরা।

ক্রিসেন্ট জুট মিল বদ্ধভুমিঃ খুলনা সদরে ভৈরব নদীর তীরে ক্রিসেন্ট জুট মিল ছিল আরেকটি বধ্যভূমি। পাকহানাদার বাহিনী এই মিলের হতভাগ্য বাঙালী শ্রমিকদের হত্যা করে তাঁদের লাশ নদীর পানিতে ছুড়ে ফেলে দিত।

ফরেস্ট ঘাট বধ্যভূমিঃ খুলনা জজ কোর্টের পিছনে ফরেস্ট ঘাটে বাঙালীদের জবাই করে হত্যা করা হত। লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হত প্রতিরাতে অন্তত ২০ জনকে জবাই করে হত্যা করা হত বলে ধারণা করেন অনেকে।

গোয়ালখালি বদ্ধভুমিঃ খুলনার গোয়ালখালিতে একটি বধ্যভূমি ছিল। এই বধ্যভূমিতে বহু মানুষ হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর এখানে বহু মানুষের কঙ্কাল ও হাড়গোড় পাওয়া যায়।

কান্তপুর বধ্যভূমিঃ স্বাধীনতার পর খুলনা শহরের উপকণ্ঠে কান্তপুরের চিতলমারিতে বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালে দপূর্বদেশদ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এই বধ্যভূমিতে বহু নরকঙ্কাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কঙ্কালগুলোতে জড়ানো রয়েছে শাড়ি অথবা লুঙ্গি। প্রতিরাতে স্থানীয় লোকজন এখানে অসহায় নর-নারীর আর্তচিৎকার এবং কান্নার শব্দ শুনতে পেতেন। আর শুনতে পেতেন বুলেটের শব্দ।

শিকারপাড়া বধ্যভুমি: শিকারপাড়া এলাকায় রয়েছে বধ্যভূমি। যুদ্ধের নয়মাস হানাদার বাহিনী এখানে বহু মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করে।

প্লাটিনাম জুট মিল বধ্যভূমিঃ খুলনা সদরে প্লাটিনাম জুট মিলে হত্যাকান্ড যেমন ছিল লোমহর্ষক, তেমনি নির্মম ও নিষ্ঠুর। মিলের জ্বলন্ত বয়লারের ভেতরে ফেলে কমপক্ষে ৫৬ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করে হানাদাররা। বয়লারের সামনে বিশ ফুট উঁচু পাকা প্রাচীরের পাশে বাঙালী শ্রমিকদের এনে বসানো হত। এরপর তাদেরকে বস্তাবন্দী করে পায়ের দিক থেকে জ্বলন্ত বয়লারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হতো।

চরেরহাট বধ্যভূমিঃ খুলনার চরের হাটে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। একাত্তরের এপ্রিলে দৌলতপুরের দিক থেকে কয়েকটি লঞ্চ খুলনার দিকে আসছিল। লঞ্চগুলো ছিল যাত্রী ভর্তি। এই চরের হাটে পাকসেনারা একে একে সব লঞ্চ থামিয়ে লঞ্চের ভিতর থেকে সবাইকে বের করে এনে নদীর তীরে হত্যা করে সবাইকে।
এছাড়াও নগরীর পার্শবর্তি এলাকায় রয়েছে বেশ কিছু বধ্যভূমি।

No comments

Powered by Blogger.