GM MEDIA

বড় শহর, ভালো শহর-খুলনা

Khulna Shib-Bari
গত নভেম্বরে নদীবিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম খুলনায়। সেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলো। যশোর থেকে পড়তে আসা কৃষি প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ বলছিলেন, ‘আমরা এখানে খুব ভালো আছি। আমাদের কোনো সেশনজট নেই। বাড়িতে বাবা-মাকে আমাদের জন্য কোনো দুশ্চিন্তা করতে হয় না। কোনো মারামারি নেই।’ পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক ফয়সাল আহমেদ বলছিলেন, ‘শিক্ষকেরা এখানে শিক্ষার্থীদের রাজনীতির কাজে লাগান না। শিক্ষকেরা সংগঠন করলেও কোনো দলাদলি নেই।’ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন একজন শিক্ষার্থী ভর্তি হন, সেদিনই তিনি জানেন, কোন সালের, কোন মাসের, কোন সপ্তাহে তাঁর শেষ বর্ষের ফলাফল প্রকাশিত হবে। বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এই পাঠদান-প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে।
খুলনা শহর দিয়ে বয়ে গেছে ময়ূর, ভৈরব ও রূপসা নদী। ময়ূর নদের ওপর যেখানে দৃষ্টিনন্দন ছোট সেতুটি হয়েছে তার উত্তর দিকে নদের প্রায় মাঝবরাবর একটি সীমানাপ্রাচীর স্থাপনা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন অথবা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে তা বন্ধ করা প্রয়োজন। নদ রক্ষায় স্থানীয় ব্যক্তিদের ভূমিকাও খুব জরুরি। খুলনা শহরের নদী প্রাণময়। রূপসায় একের পর এক পণ্যবাহী জাহাজ চলছে।
রাত্রি যাপন করেছি খুলনা সার্কিট হাউসে। সকালে সার্কিট হাউস চত্বরে লক্ষ করলাম খুলনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ৭০০-৮০০ ভিক্ষুকের সমাগম। মঞ্চের ব্যানারে লেখা, ‘ভিক্ষুক মুক্তকরণ, ভিক্ষুকদের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন সংস্থা, খুলনা কর্তৃক ভিক্ষুকদের মাঝে উপকরণসামগ্রী বিতরণ’। খুলনা বিভাগীয় কমিশনার কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন ভিক্ষুকমুক্ত খুলনা বিভাগ গড়ার। এ কর্মসূচির আওতায় গত অক্টোবর মাসে নড়াইল জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
উপস্থিত অনেক ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা হলো। কেন ভিক্ষাবৃত্তিতে এসেছেন—এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল কয়েকজনের কাছে। শেখ সোহরাব নামের একজন জন্মান্ধ বলছিলেন, ‘ভিক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নাই বাবা।’ বসুপাড়া থেকে এসেছেন আনোয়ারা বেগম। এই বয়স্ক মহিলা নিজের দুঃখের কথা বলতে বলতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। প্রায় কুড়ি বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর তিন মেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়েন। তখন থেকে বাধ্য হয়ে নিজের এক পা না থাকায় ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেন। অনেকের অপমানসূচক অনেক কথা শুনে ভিক্ষা করতে হয়। এই অপমান আর তিনি সহ্য করতে চান না। তিনি একটি চা-পানের দোকান করতে চান। একটি দোকান তিনি করতে পারবেন বলে তাঁর বিশ্বাস।
আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ভিক্ষুকেরা ভিক্ষা ছাড়ার জন্য যাঁরা যে পেশায় যেতে চান, তাঁদের সেই পেশারই ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাঁরা কাজ করতে সক্ষম তাঁরা অনেকেই চা, পান, মুদি, খড়ি, ডিম, বাদাম, পুরোনো পোশাক, ঝালমুড়ি, চানাচুরসহ অনেক কিছু বিক্রির পেশা বেছে নিয়েছেন। তাঁরা যাতে ব্যবসা করতে পারেন, তাঁদের ব্যবসায়িক সামগ্রীও বিতরণ করা হয় ওই দিনে। যাঁরা কোনো কাজ করতে পারবেন না তাঁদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ কাজ শুরু করার জন্য খুলনা বিভাগের সব সরকারি কর্মচারী এক দিনের বেতন দিয়েছেন। প্রথম দফায় ওই দিনে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ জনকে সহায়তা দেওয়া হয়। প্রথম আলো সূত্রে জানলাম, দ্বিতীয় দফায় ৮ জানুয়ারি আরও ৬১৫ জন ভিক্ষুককে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বের করে আনার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ দেওয়া হয়েছে। ভিক্ষুক কোন ওয়ার্ডে কতজন আছেন, তা সার্ভে করা হয়েছে। ওয়ার্ডভিত্তিক কতজন ভিক্ষুক, তার মধ্যে কতজন অন্ধ, বধির, হাত নেই, পা নেই, কতজন কর্মক্ষম, কতজন অক্ষম তারও একটি পরিসংখ্যান করা হয়েছে।
খুলনা শহরের সড়কগুলো বেশ প্রশস্ত। কোথাও যানজট চোখে পড়ল না। বড় বড় সড়কের মোড়ে মোড়ে দৃষ্টিনন্দন সৌধ নজর কাড়ে। খুলনায় বিচিত্র প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। পারশে, ভেটকি, বাগাড়সহ প্রচুর সামুদ্রিক মাছ খুবই সহজলভ্য। সোয়া দুই কেজি ওজনের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছিল। যদিও সাত হাজার টাকা দাম চাচ্ছিলেন বিক্রেতা। মাছ ব্যক্তিগতভাবে কিনেছেন অনেকেই। বরফ দিয়ে দুই-তিন দিন মাছ ভালো রাখার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। খুলনা থেকে প্রচুর মাছ বিদেশে রপ্তানিও হয়। মৎস্যশিল্পে সমৃদ্ধ খুলনা।
খুলনা শহরে আছে প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো মিষ্টির দোকান ‘ইন্দ্রমোহন সুইটস’। এখনো কলা পাতায় সন্দেশ দেওয়া হয়। মিষ্টি কেজি হিসেবে বিক্রি হয় না। সংখ্যা হিসেবে মিষ্টি বিক্রি হয়। প্রতিদিন যে মিষ্টি তৈরি হয়, সেই মিষ্টি ওই দিনই শেষ হয়। বাসি মিষ্টি বিক্রি হয় না।
খুলনার সঙ্গে রেল-সড়ক-নৌ—তিন ধরনের যোগাযোগ থাকার কারণে এখানকার উন্নতি বেশ ত্বরান্বিত হয়েছে। খুলনা থেকে মোংলা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাসের দাবিসংবলিত ব্যানার টাঙানো। খুলনা নিউমার্কেটের ভেতরে রয়েছে একটি নার্সারি, যা নিউমার্কেটকে একটি সবুজ আভা দান করেছে।
সন্ধ্যায় চোখে পড়ল শহীদ হাদিস পার্কে অনেক মানুষের সমাগম। পার্কের একদিকে আওয়ামী লীগের সভা হচ্ছে, অন্যদিকে বিপিএল দেখানো হচ্ছে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে। খুলনার মানুষজন খুবই সদালাপী। অনেকের সঙ্গে অনেক রকম কথা হলো। তাঁরা সবাই বেশ আন্তরিক।
খুলনা দিনের পর দিন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারাচ্ছে বলে মন্তব্য করলেন খুলনা বেতারের নাট্যকার ও অভিনেতা, খুলনার রেলস্টেশনমাস্টার আমিনুল ইসলাম। মুঠোফোন প্রযুক্তিতে তরুণদের আসক্তিকে তিনি এর কারণ বলে উল্লেখ করেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক আবুল ফজল বলছিলেন, ‘দেশ বিভাগের আগে খুলনা শহরে শতাধিক নাটক ও যাত্রাপালার সংগঠন ছিল। এখন সাংস্কৃতিকভাবে বন্ধ্যা।
খুলনায় রাজনৈতিক সহাবস্থান আছে। দেশব্যাপী যখন অবরোধের নামে জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি পালন করেছে সরকারবিরোধীরা, তখনো খুলনা ছিল শান্ত শহর। শহরে শিশুদের জন্য আছে বিনোদন পার্ক, অপ্রতুল হলেও আছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সবকিছু মিলিয়ে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও খুলনা বাংলাদেশের অনেক শহরের চেয়ে অনেক ভালো।
তুহিন ওয়াদুদশিক্ষকবেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়রংপুর

No comments

Powered by Blogger.