GM MEDIA

হেডফোনের তারে কেন প্যাঁচ লাগে ? জুতোর ফিতে কেন খুলে যায় ?


হেডফোনের তারে কেন প্যাঁচ লাগে ? জুতোর ফিতে কেন খুলে যায় ?
যদি জিজ্ঞেস করা হয় “বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী গিঁট কীভাবে লাগাবেন ?” তাহলে অনেকেই হয়তো অনেক পদ্ধতির কথা বলবেন। তবে এই প্রশ্নের উত্তরে বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতা বিল মারে বলেছিলেন, “প্রথমে একটি হেডফোন পকেটে রেখে দিন, তারপর এক মিনিট অপেক্ষা করুন”। অর্থাৎ হেডফোনে লাগা প্যাঁচটাই হবে বিশ্বের সবচাইতে শক্ত গিঁট।
অপরদিকে অনেকেই জুতো ব্যবহার করেন বা এই শীতে অনেকেই জুতো পরবেন। হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, আপনি যত শক্ত করেই জুতোর ফিতে বাঁধেন না কেন, কিছুদূর হাঁটাহাঁটি করলে বা দৌড়াদৌড়ি করলে হঠাৎ করেই ফিতে খুলে যায়। এর পেছনের রহস্যটা কী ?

চলুন আজ তাহলে দেখা যাক, কেন পকেটে থাকা হেডফোনের তারে আপনা আপনি প্যাঁচ লেগে যায়, অথচ শক্ত করে বাঁধলেও জুতোর ফিতে খুলে যায় ?
হেডফোনের তারে প্যাঁচ লাগার কারণ।
আমরা যারা গান শুনতে ভালোবাসি, তাদের জন্য হেডফোন একটি অবিচ্ছেদ্য সাথী। আর হেডফোন থাকলে হেডফোনের তারে প্যাঁচ লাগা দেখাটাও আমাদের জন্য একটা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। হেডফোন আছে অথচ হেডফোনের তারের প্যাঁচ খুলতে হয়নি এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও। আমরা কি কখনো এ সম্পর্কে ভেবে দেখেছি কেনই বা এমনটি হয় ?
আমরা অনেকেই হয়তো দোষটা আমাদের উপরেই দিয়ে থাকি এটা ভেবে যে, হয়তো এলোমেলোভাবে পকেটে ঢুকিয়ে রাখার কারণে হেডফোনের তারে প্যাঁচটা লেগেছে। কিন্তু দেখবেন আপনি সুন্দরভাবে গোল করে পেঁচিয়ে পকেটে ঢুকালেও কিন্তু তারে প্যাঁচ লাগে। তো এমন হবার কারণ বের করতে বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণাও কিন্তু করেছেন। প্রথমত তারা যে পরীক্ষা চালিয়েছেন তা হলো, তারা বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের কিছু তার একটি বাক্সে রেখে ভালভাবে ঝাঁকিয়েছেন এটা দেখতে যে তাদের মধ্যে প্যাঁচ লাগে কিনা! তারা এই পরীক্ষা একবার দু’বার করেননি, করেছেন মোট ৩,৪১৫ বার !
ডোরিয়ান এম. রেমার এবং ডগলাস ই. স্মিথ; দুজন গবেষক তাদের ‘Spontaneous knotting of an agitated string’ নামক গবেষণা পত্রে, খুব কম সময়ের মধ্যে যেকোন জটিল গিঁট লাগার দুটি মূল বিষয়ের উপরে আলোকপাত করেছেন। প্রথমটি হলো, ‘তারের তুলনামূলক দৈর্ঘ্য’ এবং দ্বিতীয়টি, ‘আলোড়ন সময়’। আলোড়ন বলতে এখানে ঝাঁকুনির ফলে তারগুলোর মধ্যে যে নড়াচড়ার সৃষ্টি হয় তা বুঝিয়েছেন।
তাদের মতে, তার যত বড় হবে এবং সেখানে আলোড়ন যত বেশি হবে, তত তারের নিজেদের ভেতর আপনা-আপনি গিঁট লাগার সম্ভাবনাও বাড়বে। প্যাঁচ লাগার ক্ষেত্রে মাঝেমাঝে তারের গুণগত মান; যেমন তারের দৃঢ়তা এবং ব্যাসও দায়ী থাকে তবে তারের দৈর্ঘ্য এবং ঝাঁকির ফলে তাদের মাঝে সৃষ্ট আলোড়নই মূলত গিঁট লাগার পেছনে বেশি দায়ী। দুর্ভাগ্যবশত, এগুলোর খুব একটা সমাধানও নেই।
রেমার এবং স্মিথ তাদের পরীক্ষায় বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের তার এবং তাদের মাঝে বিভিন্ন সময়ব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে দেখেছেন। দেখা গেছে, ৪৬ সেন্টিমিটার এবং এর থেকে ছোট তারে আপনা আপনি গিঁট লাগেনি এবং লাগার সম্ভাবনাও একদম নেই। কিন্তু ৪৬ সেন্টিমিটার থেকে যত বেশি দৈর্ঘ্যের তার নেয়া হয়েছে তত তাদের মধ্যে গিঁট লাগার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। সর্বোচ্চ ২ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত তারগুলো নিজেরাই নিজেদের মধ্যে গিঁট লাগিয়েছে। ২ মিটারের বড় তারগুলো সাধারণত বেশি দৈর্ঘ্যের কারণে পকেট জুড়ে থাকে। এজন্য ঝাঁকি পেলেও নিজেদের ভেতর আলোড়িত হবার মত জায়গা পায় না, তাই এদের মধ্যে আপনা আপনি গিঁট লাগে না।
বর্তমানে প্রচলিত হেডফোনগুলো যেগুলোর গড়ে দৈর্ঘ্য ১৩৯ সেন্টিমিটার তাদের নিজেদের ভেতরে প্যাঁচ লাগার সম্ভাবনা ৫০%। অর্থাৎ আপনার পকেটসমান জায়গা আছে এমন আবদ্ধ স্থানে এরকম দৈর্ঘ্যের হেডফোন রাখলে প্রতি দুইবারে অন্তত একবার সেই হেডফোনের তারে প্যাঁচ লাগার সম্ভাবনা থেকে যায়।
রেমার এবং স্মিথ আরো দেখেছেন, Y আকারের হেডফোনগুলোয় প্যাঁচ লাগার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। কারণ এ ধরনের হেডফোনের শুধু একটি তারের মাথা নিজের ভেতর একবার ‘ডিগবাজি’ দেয়ার মতো করে ঢুকতে পারলেই জটিল প্যাঁচের সৃষ্টি করে ফেলে। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমানে প্রচলিত সব তারের হেডফোনই দেখতে Y আকারের।
তারা তাদের পরীক্ষায় তারগুলোর মধ্যে প্রায় ১২০ রকমের গিঁটের দেখা পেয়েছেন, যেখানে অধিকাংশ গিঁটে তারগুলো নিজেদের মধ্যেই প্রায় ৭ বার করে প্যাঁচ লাগিয়েছে।
তাই এরপর থেকে কখনো পকেট থেকে হেডফোন বের করে যদি দেখেন সেটার তারগুলোয় প্যাঁচ লেগেছে, তাহলে অবশ্যই নিজেকে আর দোষ দেবেন না!

 জুতোর ফিতে
জুতোর ফিতে কেন খুলে যায় ?

ফুটবল খেলায় দেখবেন মাঝে মাঝেই খেলোয়াড়রা তাদের জুতোর ফিতে ঠিক করছে। কারণ তাদের সব সময়ে দৌড়ের উপর থাকতে হয় এবং যার জন্য জুতোর ফিতের গিঁট একসময় আলগা হয়ে গিয়ে তা খুলে যায়। এখন প্রশ্ন হলো, কেন এমন হয় ?
বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে পেরেছেন। গিঁট আলগা হয়ে হঠাৎ করে জুতোর ফিতে খুলে যাবার কারণ অনুসন্ধান করতে বিজ্ঞানীরা এই পুরো প্রক্রিয়াটাকে একটি প্রামাণ্যচিত্রে রূপ দিয়েছিলেন, যা সম্ভব হয়েছিলো একটি ক্যামেরাতে স্লো-মোশন ভিডিও রেকর্ডের মাধ্যমে। তাদের মতে, জুতোর ফিতে খুলে যাওয়ার পেছনে একধরনের শক্তিশালী বল দায়ী।
পরীক্ষাটি করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রফেসর অলিভার ও’রেইলি। তিনি একটি উচ্চগতি সম্পন্ন ক্যামেরা ধার করেছিলেন। তারপর একজন দৌড়বিদকে জুতো পায়ে একটি ট্রেডমিলে দৌড়াতে বলেছিলেন। তিনি সেই দৌড়টা ভিডিও করেছেন। এ সম্পর্কে ও’রেইলি বলেন, “বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করার পরও কিছু ঘটলো না, তারপর হঠাৎ করেই একসময় ঘটে গেলো ব্যাপারটা! জুতোর ফিতে দুটো খুলে গেলো আপনা-আপনি। এতো দ্রুত ঘটে গেলো পুরো ব্যাপারটা যে আমরা এতে খুব অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা আরও উৎসাহিত হলাম এর পেছনের কারণটা বের করার জন্য।”
দৌড়ের ফলে কীভাবে জুতোর ফিতে খুলে গেলো সেটা বের করার জন্য তিনি একটি এক্সেলেরোমিটার ব্যবহার করলেন। সেটার সাহায্যে জুতোর উপর জি-ফোর্স বা মহাকর্ষীয় বল পরিমাপ করে দেখলেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, জুতোর ফিতের সেই গিঁটের উপর যে মহাকর্ষীয় বল কাজ করছিলো, তা ৭ জি-এরও বেশি। ৭ জি কেমন শক্তিশালী বল সেটা বুঝাতে হলে পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী রোলার-কোস্টার, জোহানসবার্গের ‘দ্য টাওয়ার অব টেরর’ এর কথা বলা যেতে পারে। যেটি সর্বোচ্চ ৬.৩ জি মহাকর্ষীয় বল সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ এর থেকে জুতোর ফিতের উপরে কাজ করা বলের পরিমাণই ছিল বেশি !
এ থেকে বোঝা যায়, যত দৌড়ানো হয়, মহাকর্ষীয় বলের প্রভাব তত জুতোর ফিতে ও তার গিঁটের উপর গিয়ে পড়ে। এই প্রবল বলের প্রভাবে একসময় ফিতের গিঁট আলগা হয়ে যায়। পাশাপাশি, দৌড়াতে থাকলে ফিতে দু’টির মুক্ত প্রান্ত বার বার উপরে-নিচে এবং সামনে-পেছনে ঝাঁকি খেতে থাকে। মহাকর্ষীয় বল এবং এই ঝাঁকির ফলে ফিতে দুটির মুক্ত প্রান্তে একধরনের গতির সৃষ্টি হয়। এই গতিই ফিতে দুটির মাথায় এক অদৃশ্য হাতের কাজ করে, যা ফিতে দুটির মুক্ত প্রান্ত টেনে ধরে; ফলাফলস্বরূপ ফিতে দুটি পুরোপুরিভাবে খুলে যায়।

No comments

Powered by Blogger.