GM MEDIA

মানুষ হতে চাই, বিত্তবান নয়|সজীব অধিকারী |GM MEDIA

সজীব অধিকারী
সজীব অধিকারী:
মানুষ হতে চাই, বিত্তবান নয়

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার এর সন্তান হয়ে জন্ম নিয়েছি। ছোট বেলা থেকেই বাবাকে ইট,বালি,সিমেন্ট নিয়ে কাজ করতে দেখেছি । যখন ক্লাস ৫ম শ্রেনিতে পড়ি তখন সমাজ বইয়ে পড়েছিলাম যে যারা ইট,বালি,সিমেন্ট নিয়ে কাজ করে এবং ওই গুলো দিয়ে বাড়ি তৈরি করে তাদের নাকি রাজমিস্ত্রি বলে এবং বইয়ে লেখা ছিল রাজমিস্ত্রি অনেক বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করে ।

আমি তখন খুব ছোট, তখন আমার বয়স বেশি হলে ১০ কী ১১ বছর হবে । তাই সেই বয়সে আমার যা মনে করার কথা, আমি ঠিক সেটাই মনে করলাম । ভাবলাম, আমার বাবার তৈরি সব বাড়ি আমার!!! ছোট একটি কুড়ে ঘরে বাবা-মা আর আমি থাকি। মাঝে মাঝে প্রচন্ড বৃষ্টি হলে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখতো যেন বৃষ্টির ফোঁটা আমার গায়ে না লাগে । যখন পূর্নিমা রাত আসতো তখন আমরা সবাই বিছানা থেকে পূর্নিমার চাঁদটা দেখতে পেতাম। একদিন হঠাৎ করে বাবা কে জিজ্ঞাসা করলাম-"বাবা! বাবা! ও বাবা! তুমি তো কত বড় বড় বাড়ি তৈরি করো কিন্তু আমরা কেন এই ভাঙ্গা গোলপাতা নিচে থাকি?" বাবা কিছু না বলেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে দিয়ে বলল , "বাবা তুমি যখন বড় হবে তখন তোমার এই প্রশ্নের উওরটা তুমি নিজেই বুঝতে পারবে যে কেন আমরা এভাবে থাকি।" আমি বাবা কে চোখের জল মুছে দিয়ে বলেছিলাম, "বাবা তুমি কেঁদো না । আমি খুব তারাতারি বড় হয়ে তোমাকে বড় একটা বাড়ি তৈরি করে দিব।" তখন আমার কথাটি বাবা-মা শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরে দুইজন খুব কান্না করেছিল। আমার এখন ও মনে আছে যে বাবা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলেছিল, "সজিব তুই আমার গর্ব রে বাপ! তুই আমার গর্ব! কোন এক পর্যায়ে আমি বলেছিলাম বাবাকে, "এই বোকা বাবা তুমি কাঁদছো কেন??আমি তো আছি!!!" বাবার ঠোঁটের কোণে তখন বাঁকা চাঁদের হাসি ফুটে উঠেছিলো । এই ঘটনার পর অনেক দিন কেটে গেলো,,,,

আজ আমি সত্যি অনেক বড় হয়েছি,উপলব্দি করতে শিখেছি যে আমার বাবার তৈরি বাড়িটি আসলেই তার ছিলো না । সেখানে শুধু ছিল তার ঘাম ঝরানো কষ্ট । যার সাথে ইট,বালি সিমেন্টের মিশ্রণে তৈরি হয়েছিলো একজন ধনী ব্যক্তির বিরাট বাড়ি!! আমার বাবা সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সেই বাড়ির প্রতিটা ইটকে একত্রিত করে অট্টালিকা করতে সাহায্য করেছিলো মাত্র । আজ আমি বুঝতে শিখেছি আমার বাবা কতটা কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে। আজ আমি বুঝতে শিখেছি ঠিকই কিন্তু যার কাছে গিয়ে শ্রদ্ধাভরা মিষ্টি কন্ঠে বলবো, "বাবা আমি আজ সত্যি বড় হয়েছি । আমি বুঝতে শিখেছি তোমার কষ্ট গুলো। তোমাকে আর কষ্ট করতে দিবো না । আমিই তোমাদের দায়িত্ব নিবো ।" কিন্তু আমার আবেগী কথাগুলো বুকের মাঝেই জমা রয়ে গেলো । আমার বাবার সেই কর্মই তাঁকে কেঁড়ে নিয়েছে আমার আর মায়ের কাছ থেকে ।বাবা ভবনের কাজ করতে গিয়ে সামান্য ভুলে মালিকের ধস্তাধস্তিতে পড়ে গিয়েছিল ১০ তলা থেকে। আমাদেরকে শূণ্য করে দিয়ে হারিয়ে গেলো সে । বাবা জীবনের বিনিময়ে মূল্য হিসেবে পেয়েছিলাম ৫০ হাজার টাকা"! আমার মা একটা কাজ চেয়েছিলো আমাকে মানুষ করার জন্য । কিন্তু তাড়িয়ে দিয়েছিলো তাকে যাতে বাবার মৃত্যুর বিরোধিতা করার কোনো জায়গা না থাকে । হয়তো মায়ের অনেক কষ্ট হতো আমার পড়াশোনা চালাতে তবুও আমাকে হারিয়ে যেতে দেয় নি অন্ধকার জীবনে । আমার মা আমাকে বাবার আদর্শ দিয়ে বড় করে তুলেছে । এখন আমি কুয়েট থেকে পাশ করা একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার!!!

আজ আমি প্রথম আমার জীবনের সব থেকে বড় প্রজেক্ট এর দ্বায়িত্ব পেলাম। তাও খুলনার সর্বপ্রথম ৫ স্টার হোটেলের; এমনকি সেই হোটেল নির্মানের হেড ইঞ্জিনিয়ার আমি । জীবনের এই পর্যায়ে এসে বুঝতে পেরেছি কর্মকর্তা সব সময় কর্মচারীর রক্ত চুষে চুষে খায় এবং নিজে কোটিপতি থেকে কোটিপতি হওয়ার নেশা যায় না । কিন্তু কর্মচারী সারাদিন কাজ করে হাজারপতি ও হতে পারে না!!!

তাদের সামান্য সম্মানটুকু ও দিতে বিত্তবানদের খুব মানে লাগে । কেননা তারা যে কর্মচারী!!! বিত্তবান শুধু ব্যবহার করে সকল কর্মচারীদেরকে এবং আমার বাবার মত যখন অন্য লোকের একজন কর্মচারী বাবা তার কর্মের মাধ্যমে হাত,পা বা জীবনটা হারায় তখন তার জীবনের মূল্য ৫০ হাজার টাকা বা তার কম-বেশি দিয়ে ওই গল্পের সমাপ্ত করে । অনেকক্ষেত্রে টাকা না দেওয়ার ও টালবাহানা চলে । সময়টা এবং বাস্তবটা এমন ই । সমাজে হাজার কোটিপতি প্রতিনিয়ত কোটিপতি থেকে আরো কোটিপতি হচ্ছে কিন্তু একজন কর্মচারী হাজারপতি ও হতে পারছে না। তবে বাবা জানো, আমি কোটিপতি হতে চাই না, আমি তোমার আদর্শ নিয়ে কাজ করে মায়ের কোলে শুয়ে গোলপাতার ঘরের ফাঁক দিয়ে সেই পূর্নিমা চাঁদ দেখতে চাই । বড্ড মনে পড়ে বাবা তোমাকে আজ! খুব ইচ্ছা করে তোমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে, "বাবা এখন আমি ইঞ্জিনিয়ার ঠিকই। কিন্তু তোমাকে তো ওই কোটিপতি লোক গুলোর কাজই আমার আর মায়ের কাছ থেকে তোমাকে কেঁড়ে নিয়েছে । বাবা তুমি ভালো থেকো। তোমার সজিব কোটিপতি হতে চায় না তোমার মত একজন পরিশ্রমী মানুষ হয়ে বাঁচতে চায় । অসহায়ের পাশে দাঁড়াতে চায় ।

No comments

Powered by Blogger.